সংকলন ৩১- একটি মেয়ের আত্মকাহিনী
লেখাঃ 'Abid Ahmed Chowdhury
একটা চিঠি লিখতে বসেছি, চিঠিটা কার কাছে লিখতেছি ঠিক জানি না। প্রাপকের
নামটা ফাঁকা রেখে দিলাম, যে'ই পড়বেন ধরে নিবেন আপনার উদ্দেশ্যে লিখেছি। আমি একটা মেয়ে, আর
চিঠিটা আমার জীবন কাহিনী নিয়ে। চিঠিটা পড়ে অনুভুতীটা কেমন হয় সেটা বলার
প্রয়োজন নেই, শুধু এখানে আমার দোষটা কোথায়একটু খোঁজে দিলে খুশি হব...আমার নাম রোকেয়া,
না এটা ইতিহাসের কোন কালজয়ী নারীর নাম নয়। এটা প্রত্যন্ত কোন এক গ্রামের এক লাঞ্চিত,
বঞ্চিত, হতভাগা মেয়ের নাম। ২০১১ সালে আমি এসএসসি পরীক্ষা দেই,
ব্যাবসা শাখা থেকে, মোটামুটি ভালো একটা ফলাফল পাই, জিপিএ ৪.৮৩। বাবা ছিলেন একজন মুক্তিযুদ্ধা,
এখনো বেঁচে আছেন। আর্থিক দিক দিয়ে না হলেও এলাকায় অনেক সম্মানী একজন মানুষ,
বর্তমানে একটা আঞ্চলিক সমীতির সভাপতি। পরিবারে অন্যদের মধ্যে আমি, ভাইয়া-ভাবী, আর মা।
আমার মা আমার জন্মের আগ থেকেই স্কুল শিক্ষিকা, স্থানীয় একটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ান।
ভাইয়াটা নৌ-বাহিনীতে চাকরি করে, বেশির ভাগ সময়টাই তার নৌ-ক্যাম্পে থাকে। আর ভাবীর
সারাটা দিনই বাড়িতে কাটে। আমার জীবনটা অন্য আট-দশটা মেয়ের মত অনেক
সাধারণ ছিল। হাসি-খুসিতে ভরপূর অনেক সুন্দর সাজানো-গোছানো। কিন্তু সে সুখ খুব বেশী দিনের
জন্য স্থায়ী ছিল না আমার জীবনে। কলেজ জীবনে পা দিয়ে খুব বেশী দিন হয়নি, কয়েক মাসের
মাথায় বাবার কাছে একটা বিয়ের প্রস্তাব আসে। ছেলে দুবাই থাকে, একমাত্র ছেলে, পরিবারে মা-
বাবা আর এক ছোট বোন। পাত্র পক্ষের কোন চাহিদা নেই, সঙ্গে বিয়ের পর আমার
লেখাপড়া চালিয়ে যেতে কোন বাধা থাকবে না। আমার পরিবার থেকে হুট করেই বিয়েটা ঠিক করে দেন, বাবার
কথায় এমন প্রস্তাব সব সময় পাওয়া যায় না, আর উনি সব সময় নাকি আমার জন্য এরকমই
একটা ছেলে চেয়ে ছিলেন। তখনও আমি পাত্র দেখিনি, আমাকে কেবল একটা ছবি দেখানো হয়েছিল, ছেলের
ক্ষেত্রেও একই। ছেলে তিন মাস পর দেশে আসবে, তবে আগে থেকেই বিয়ের সব কথাবার্তা ঠিক
করে রেখে দেওয়া হয়ে গেছে। ছেলে দেশে আসলো, সবকিছু আগের কথা অনুযায়ী। পরিবারকে উপেক্ষা করার মত ক্ষমতা আমার ছিল না, তবে অনেক বলেছিলাম, কেউ শুনেনি। আমাকে বলা হয়েছিল আমার পছন্দের কেউ
থাকলে বলার জন্য, কিন্তু সত্যিকার অর্থে আমার তেমন কেউ ছিল না। আমার কথা ছিল সেই
মুহুর্থে বিয়ের জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না, তাছাড়া পাত্র পছন্দেরও একটা বিষয় ছিল। কিন্তু
আমার কোন কথার মূল্য দেওয়া হয়নি, আমার পূরোপূরি অমতে বিয়েটা হল। বিয়ের প্রথম
কয়েকটা দিন আমার সাথে অনেক ভালো ব্যবহার
করা হয়েছিল, কিন্তু অল্প কিছুদিনের ব্যাবধানেই আমি বুঝে উটতে শুরু করলাম আমাকে আমার
বাবা হিংস্র জন্তুদের বসবাস করা একটা জঙ্গলে ছেড়ে দিয়েছেন। আমার
বয়সটা তখন মাত্র সতেরর কোটায়, কিন্তু তখনই আমার জীবনে মোকাবেলা করতে হয়েছিল এমন কিছু
পরিস্তিতির যা কোন সাধারণ মানুষ একজন অন্যজনের জন্য কখনো কল্পনাও করবে না।
আমাকে বিয়ে করে সে ঘরে যেন বৌ হিসাবে না, চাকরানী হিসাবে নেওয়া হয়েছি। আমার বাবার বাড়ির
কাজের মানুষ গুলোও আমার সেই অবস্থা থেকে অনেক ভালো ব্যবহার পেত। সকালে সূর্যদয়ের
সাথে সাথে ঘুম থেকে উটে শুরু হত আমার কাজ, আর সূর্যাস্ত পর্যন্ত সব কাজ করতে হত
আমাকে একা একা। আর তারা মা-মেয়ে সারাদিন বসে বসে টিভি দেখা আর গল্প করার মধ্য
দিয়ে কাটাতো। তাদের বাবার আচরণটাও ছিল এরকমই, সবকিছু দেখেও যেন অদৃশ্য করার চেষ্টা। এমনকি বিয়ের
কয়েকদিনের পরেই ঘরের সব কাজের লোক বিদায় করে দেওয়া হয়েছিল। পরিবারের এতজন মানুষের
রান্না করা, কাপড় ধৌয়া, বাড়ি পরিষ্কার করা, ঘর মুছা, তালা-বাসন মাজা, এমনকি গোয়ালের গরু
গুলোকে খাওয়া দেওয়া তাদের কাঁদা গুলোও পরিষ্কার করার কাজ করতে হত আমাকে। তার উপর তো তাদের
একেক জনের একেক সময়ের এটা সেটার কাজ, কয়েকটা কাজের মানুষের সারা বেলার কাজ
গুলো করতে হত আমি একজনকে। এরপরেও কোন কিছুর অমিল পেলে আমার উপর করা হত মানুসিক
নির্যাতন। সারাদিনের এত পরিশ্রম করে এসে রাত্রি বেলা আর পড়ালেখা করার মত
শারিরিক বা মানুসিক কোন অবস্থাটাই থাকতো না। এরপরেও রাতের খাওয়া-দাওয়া আর সব কাজ কর্ম
শেষে একটু পড়তে বসলে কিছুক্ষনের মধ্যেই শুরু হত ছেলে অর্থ্যাৎ আমার স্বামী কতৃক চেচামেচি। আমার
অনিচ্ছা সত্তেও আমার উপর করা হত পাশবিক নির্যাতন, যেটা ছিল অনেকটা প্রতিদিন একজন
ব্যাক্তির কাছে ধর্ষন হওয়ার মত। এতকিছুর পরও আমার সেগুলো বলার মত কেউ ছিল না, শুরু থেকেই
আমার পরিবারের সাথে কোন যোগাযোগ করতে দেওয়া হত না, ঘরে কোন ল্যান্ড লাইন ছিল না,
শুধুমাত্র আমার বাবা-মা ফোন দিলে কয়েক মিনিটেরজন্য কথা বলতে দেওয়া হত, তাও পূরো পাহারার মধ্যে রেখে যাতে তাদের কর্মকান্ডের কোন কথাই আমি আমার পরিবারের কাছে না জানাতে পারি।
হুমকি থাকতো জানালে সেটার পরিমাণ আরো ভয়াবহ হবে। তাই দিন শেষে নিজের কপালের কাছে হার
মেনে নিরবে চোখের পানি ফেলা আর উপরওয়ালার কাছে সাহায্য চাওয়া ছাড়া আমার আর করার কিছু
থাকতো না। বিয়ের চার মাসের মাথায় ছেলেটা আবার দুবাই
চলে যায়। আর সেটার পরই তার পরিবার কতৃক শুরু হয় আমার উপর মাত্রাতিক্ত নির্যাতন, আমার
বয়সি কোন মেয়ের জন্য যেটা ছিল সহ্য সীমার বাইরে। শুরু হয় আমার উপর শারিরিক অত্যাচার,
যেটা এপর্যন্ত বাকি ছিল। এপর্যায়ে আমার একটু ত্রুটি-বিচ্যুতিতেই আমাকে অমানবিক ভাবে মারধর
করা হত, কোন কোন সময় গলাটিপে মেরে ফেলার চেষ্টাও করা হত। চোখ
গুলো ভিজতে ভিজতে একসময় সেগুলো শুকাতে শুরু করলো। বিয়ের পর থেকে আমাকে কোনদিনও বাবার
বাড়িতে যেতে দেওয়া হত না, আমার মা'র স্কুল থাকতো, ভাইয়া তো চাকরির কারনে বরাবরই বাড়ির
বাইরে থাকতেন, হাতে গুনা দুই-একদিন বাবা বেড়াতে এসেছিলেন। কিন্তু আমার স্বামী যাওয়ার
পর থেকে এখনো কেউ আসেননি, আর আমার সেরকমই পরিস্তিতিতে কোন একদিন আমার
ভাইয়া ছুটিতে বাড়ি আসে, আর পরে কোন একদিন আমার শশুর বাড়িতে বেড়াতে যায়। আর সেদিনই তার
সাথে করে আমি আমার বাবার বাড়িতে চলে আসি। বাবার বাড়িতে এসে সবাইকে সেখানে কাটানো আমার
লোমহর্ষ এক-একটি দিনের বর্ণনা দেই। কান্নারত অবস্থায় সবাইকে জানিয়ে দেই আমি আর সেই
বাড়িতে ফিরবো না, পরিবারের সবাই তখন বাকরুদ্ধ। আমার পরিবার থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ডিভোর্সের
জন্য, কিছুদিনের মধ্যে ইসলামিক রীতি মেনে আইনী প্রক্রিয়ায় আমার পক্ষ
থেকে ডিভোর্সের সব কাগজ পাটিয়ে দেই তাদের কাছে। উকিলের মাধম্যে বলা হয়েছিল আমার কোন
দাবী বা চাওয়া-পাওয়ার হিসাব আছে কিনা, আমি মহরের টাকাটাও চাইনি, কারণ আমার শুধু
সে বাড়ি থেকে মুক্তি দরকার ছিল, আমি শুধু বাঁচতে চেয়েছিলাম,
সে বাড়িতে থাকলে হয়তো আমি আর বাঁচতেও পারতাম
না। কয়েকদিন পরেই আমার ইন্টার পরীক্ষা চলে আসলো,
অস্বাভবিক পরিস্তিতির কারণে পড়ালেখা কোন ভাবেই করা হয়ে উটেনি। তবুও পরীক্ষাটা দিলাম,
ফলাফল স্বরুপ গ্রেড পয়েন্ট এসএসসি থেকে অর্ধেকের নিচে নেমে আসলো, কোন মতে পাস করলাম, জিপিএ
২.১০। অনেক ইচ্ছে ছিল একটা পাবলিকবিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার, সেটা আর হয়ে উটলো না। শেষ
পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আর লেখাপড়া বন্ধ করে দিবো, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বা ডিগ্রিটাতেও
পড়বো না। একবছর গেপ দিয়ে সদ্যইএকটা ডিগ্রি কলেজে ভর্তি হয়েছি,
ইচ্ছা জীবনে নিজে কিছু একটা করার, মাত্র কয়েকদিনের ব্যাবধানে আমার
জীবনটা যতটা পিছিয়ে গেছে, আমি আবার সেখান থেকে শুরু করতে চাই। এই
একবছরে আরো কয়েকটা বিয়ের প্রস্তাব এসেছিল,
কেউ চায় একটা গাড়ি, কেউ বা ছোট কোন ফ্ল্যাট, কেউ বা নগদ অর্থ। কারণটা কি? কারণ আমি একজন
ডিভোর্সি। কিন্তু জানেন আমার বয়সটা মাত্র ১৯ পেরুলো। আমার একটা ক্লাসমিট ছেলে ছিল একদিন
তার কাছে আমার জীবনে ঘটে যাওয়া কাহিনী গুলো বলছিলাম, সব কিছু
শুনে সে আমাকে বলল তার সাথে বিছানায় যাওয়া জন্য, আমি নাকি নষ্ট হয়ে গেছি, আমার নাকি আর কোন
মূল্য নেই, তাহলে তার সাথে যেতে সমস্যা কোথায়? সেদিন একটা বিয়ে বাড়িতে গিয়েছিলাম, কনে সাজানোর
মত তেমন ভালো কেউ ছিল না, তাই কয়েকজন আমাকে বললে আমি সাজিয়ে দিতে যাই। নিজের কানে শুনিনি তবে পরে কেউ একজন এসে বলে, আমাকে সাজাতে দেখে কনের মা নাকি ফিসফিস
করছিল, এমন শুভদিনে এমন অলক্ষি মেয়েকে দিয়ে সাজানোর কথা কে বলেছে?
অনেক হাঁসি পায়, আমি নাকি এখন অলক্ষি হয়ে গেছি, কিন্তু আমার জন্মের পর আমাকে সবাই অনেক আদর
করতো, সবাই বলতো আমি নাকি আমার বাবার
অনেক লক্ষি মেয়ে হয়ে জন্মেছি। এই আন্টিটাও
ছোটবেলায় আমাকে অনেক আদর করতো, আজ তার কাছেও আমি একজন অলক্ষি মেয়ে হয়ে গেছি। আজ
সবার কাছে আমি একজন নষ্ট, অলক্ষি মেয়ে...
ইতি,
একজন নষ্ট, অলক্ষি মেয়ে!
একটা চিঠি লিখতে বসেছি, চিঠিটা কার কাছে লিখতেছি ঠিক জানি না। প্রাপকের
নামটা ফাঁকা রেখে দিলাম, যে'ই পড়বেন ধরে নিবেন আপনার উদ্দেশ্যে লিখেছি। আমি একটা মেয়ে, আর
চিঠিটা আমার জীবন কাহিনী নিয়ে। চিঠিটা পড়ে অনুভুতীটা কেমন হয় সেটা বলার
প্রয়োজন নেই, শুধু এখানে আমার দোষটা কোথায়একটু খোঁজে দিলে খুশি হব...আমার নাম রোকেয়া,
না এটা ইতিহাসের কোন কালজয়ী নারীর নাম নয়। এটা প্রত্যন্ত কোন এক গ্রামের এক লাঞ্চিত,
বঞ্চিত, হতভাগা মেয়ের নাম। ২০১১ সালে আমি এসএসসি পরীক্ষা দেই,
ব্যাবসা শাখা থেকে, মোটামুটি ভালো একটা ফলাফল পাই, জিপিএ ৪.৮৩। বাবা ছিলেন একজন মুক্তিযুদ্ধা,
এখনো বেঁচে আছেন। আর্থিক দিক দিয়ে না হলেও এলাকায় অনেক সম্মানী একজন মানুষ,
বর্তমানে একটা আঞ্চলিক সমীতির সভাপতি। পরিবারে অন্যদের মধ্যে আমি, ভাইয়া-ভাবী, আর মা।
আমার মা আমার জন্মের আগ থেকেই স্কুল শিক্ষিকা, স্থানীয় একটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ান।
ভাইয়াটা নৌ-বাহিনীতে চাকরি করে, বেশির ভাগ সময়টাই তার নৌ-ক্যাম্পে থাকে। আর ভাবীর
সারাটা দিনই বাড়িতে কাটে। আমার জীবনটা অন্য আট-দশটা মেয়ের মত অনেক
সাধারণ ছিল। হাসি-খুসিতে ভরপূর অনেক সুন্দর সাজানো-গোছানো। কিন্তু সে সুখ খুব বেশী দিনের
জন্য স্থায়ী ছিল না আমার জীবনে। কলেজ জীবনে পা দিয়ে খুব বেশী দিন হয়নি, কয়েক মাসের
মাথায় বাবার কাছে একটা বিয়ের প্রস্তাব আসে। ছেলে দুবাই থাকে, একমাত্র ছেলে, পরিবারে মা-
বাবা আর এক ছোট বোন। পাত্র পক্ষের কোন চাহিদা নেই, সঙ্গে বিয়ের পর আমার
লেখাপড়া চালিয়ে যেতে কোন বাধা থাকবে না। আমার পরিবার থেকে হুট করেই বিয়েটা ঠিক করে দেন, বাবার
কথায় এমন প্রস্তাব সব সময় পাওয়া যায় না, আর উনি সব সময় নাকি আমার জন্য এরকমই
একটা ছেলে চেয়ে ছিলেন। তখনও আমি পাত্র দেখিনি, আমাকে কেবল একটা ছবি দেখানো হয়েছিল, ছেলের
ক্ষেত্রেও একই। ছেলে তিন মাস পর দেশে আসবে, তবে আগে থেকেই বিয়ের সব কথাবার্তা ঠিক
করে রেখে দেওয়া হয়ে গেছে। ছেলে দেশে আসলো, সবকিছু আগের কথা অনুযায়ী। পরিবারকে উপেক্ষা করার মত ক্ষমতা আমার ছিল না, তবে অনেক বলেছিলাম, কেউ শুনেনি। আমাকে বলা হয়েছিল আমার পছন্দের কেউ
থাকলে বলার জন্য, কিন্তু সত্যিকার অর্থে আমার তেমন কেউ ছিল না। আমার কথা ছিল সেই
মুহুর্থে বিয়ের জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না, তাছাড়া পাত্র পছন্দেরও একটা বিষয় ছিল। কিন্তু
আমার কোন কথার মূল্য দেওয়া হয়নি, আমার পূরোপূরি অমতে বিয়েটা হল। বিয়ের প্রথম
কয়েকটা দিন আমার সাথে অনেক ভালো ব্যবহার
করা হয়েছিল, কিন্তু অল্প কিছুদিনের ব্যাবধানেই আমি বুঝে উটতে শুরু করলাম আমাকে আমার
বাবা হিংস্র জন্তুদের বসবাস করা একটা জঙ্গলে ছেড়ে দিয়েছেন। আমার
বয়সটা তখন মাত্র সতেরর কোটায়, কিন্তু তখনই আমার জীবনে মোকাবেলা করতে হয়েছিল এমন কিছু
পরিস্তিতির যা কোন সাধারণ মানুষ একজন অন্যজনের জন্য কখনো কল্পনাও করবে না।
আমাকে বিয়ে করে সে ঘরে যেন বৌ হিসাবে না, চাকরানী হিসাবে নেওয়া হয়েছি। আমার বাবার বাড়ির
কাজের মানুষ গুলোও আমার সেই অবস্থা থেকে অনেক ভালো ব্যবহার পেত। সকালে সূর্যদয়ের
সাথে সাথে ঘুম থেকে উটে শুরু হত আমার কাজ, আর সূর্যাস্ত পর্যন্ত সব কাজ করতে হত
আমাকে একা একা। আর তারা মা-মেয়ে সারাদিন বসে বসে টিভি দেখা আর গল্প করার মধ্য
দিয়ে কাটাতো। তাদের বাবার আচরণটাও ছিল এরকমই, সবকিছু দেখেও যেন অদৃশ্য করার চেষ্টা। এমনকি বিয়ের
কয়েকদিনের পরেই ঘরের সব কাজের লোক বিদায় করে দেওয়া হয়েছিল। পরিবারের এতজন মানুষের
রান্না করা, কাপড় ধৌয়া, বাড়ি পরিষ্কার করা, ঘর মুছা, তালা-বাসন মাজা, এমনকি গোয়ালের গরু
গুলোকে খাওয়া দেওয়া তাদের কাঁদা গুলোও পরিষ্কার করার কাজ করতে হত আমাকে। তার উপর তো তাদের
একেক জনের একেক সময়ের এটা সেটার কাজ, কয়েকটা কাজের মানুষের সারা বেলার কাজ
গুলো করতে হত আমি একজনকে। এরপরেও কোন কিছুর অমিল পেলে আমার উপর করা হত মানুসিক
নির্যাতন। সারাদিনের এত পরিশ্রম করে এসে রাত্রি বেলা আর পড়ালেখা করার মত
শারিরিক বা মানুসিক কোন অবস্থাটাই থাকতো না। এরপরেও রাতের খাওয়া-দাওয়া আর সব কাজ কর্ম
শেষে একটু পড়তে বসলে কিছুক্ষনের মধ্যেই শুরু হত ছেলে অর্থ্যাৎ আমার স্বামী কতৃক চেচামেচি। আমার
অনিচ্ছা সত্তেও আমার উপর করা হত পাশবিক নির্যাতন, যেটা ছিল অনেকটা প্রতিদিন একজন
ব্যাক্তির কাছে ধর্ষন হওয়ার মত। এতকিছুর পরও আমার সেগুলো বলার মত কেউ ছিল না, শুরু থেকেই
আমার পরিবারের সাথে কোন যোগাযোগ করতে দেওয়া হত না, ঘরে কোন ল্যান্ড লাইন ছিল না,
শুধুমাত্র আমার বাবা-মা ফোন দিলে কয়েক মিনিটেরজন্য কথা বলতে দেওয়া হত, তাও পূরো পাহারার মধ্যে রেখে যাতে তাদের কর্মকান্ডের কোন কথাই আমি আমার পরিবারের কাছে না জানাতে পারি।
হুমকি থাকতো জানালে সেটার পরিমাণ আরো ভয়াবহ হবে। তাই দিন শেষে নিজের কপালের কাছে হার
মেনে নিরবে চোখের পানি ফেলা আর উপরওয়ালার কাছে সাহায্য চাওয়া ছাড়া আমার আর করার কিছু
থাকতো না। বিয়ের চার মাসের মাথায় ছেলেটা আবার দুবাই
চলে যায়। আর সেটার পরই তার পরিবার কতৃক শুরু হয় আমার উপর মাত্রাতিক্ত নির্যাতন, আমার
বয়সি কোন মেয়ের জন্য যেটা ছিল সহ্য সীমার বাইরে। শুরু হয় আমার উপর শারিরিক অত্যাচার,
যেটা এপর্যন্ত বাকি ছিল। এপর্যায়ে আমার একটু ত্রুটি-বিচ্যুতিতেই আমাকে অমানবিক ভাবে মারধর
করা হত, কোন কোন সময় গলাটিপে মেরে ফেলার চেষ্টাও করা হত। চোখ
গুলো ভিজতে ভিজতে একসময় সেগুলো শুকাতে শুরু করলো। বিয়ের পর থেকে আমাকে কোনদিনও বাবার
বাড়িতে যেতে দেওয়া হত না, আমার মা'র স্কুল থাকতো, ভাইয়া তো চাকরির কারনে বরাবরই বাড়ির
বাইরে থাকতেন, হাতে গুনা দুই-একদিন বাবা বেড়াতে এসেছিলেন। কিন্তু আমার স্বামী যাওয়ার
পর থেকে এখনো কেউ আসেননি, আর আমার সেরকমই পরিস্তিতিতে কোন একদিন আমার
ভাইয়া ছুটিতে বাড়ি আসে, আর পরে কোন একদিন আমার শশুর বাড়িতে বেড়াতে যায়। আর সেদিনই তার
সাথে করে আমি আমার বাবার বাড়িতে চলে আসি। বাবার বাড়িতে এসে সবাইকে সেখানে কাটানো আমার
লোমহর্ষ এক-একটি দিনের বর্ণনা দেই। কান্নারত অবস্থায় সবাইকে জানিয়ে দেই আমি আর সেই
বাড়িতে ফিরবো না, পরিবারের সবাই তখন বাকরুদ্ধ। আমার পরিবার থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ডিভোর্সের
জন্য, কিছুদিনের মধ্যে ইসলামিক রীতি মেনে আইনী প্রক্রিয়ায় আমার পক্ষ
থেকে ডিভোর্সের সব কাগজ পাটিয়ে দেই তাদের কাছে। উকিলের মাধম্যে বলা হয়েছিল আমার কোন
দাবী বা চাওয়া-পাওয়ার হিসাব আছে কিনা, আমি মহরের টাকাটাও চাইনি, কারণ আমার শুধু
সে বাড়ি থেকে মুক্তি দরকার ছিল, আমি শুধু বাঁচতে চেয়েছিলাম,
সে বাড়িতে থাকলে হয়তো আমি আর বাঁচতেও পারতাম
না। কয়েকদিন পরেই আমার ইন্টার পরীক্ষা চলে আসলো,
অস্বাভবিক পরিস্তিতির কারণে পড়ালেখা কোন ভাবেই করা হয়ে উটেনি। তবুও পরীক্ষাটা দিলাম,
ফলাফল স্বরুপ গ্রেড পয়েন্ট এসএসসি থেকে অর্ধেকের নিচে নেমে আসলো, কোন মতে পাস করলাম, জিপিএ
২.১০। অনেক ইচ্ছে ছিল একটা পাবলিকবিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার, সেটা আর হয়ে উটলো না। শেষ
পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আর লেখাপড়া বন্ধ করে দিবো, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বা ডিগ্রিটাতেও
পড়বো না। একবছর গেপ দিয়ে সদ্যইএকটা ডিগ্রি কলেজে ভর্তি হয়েছি,
ইচ্ছা জীবনে নিজে কিছু একটা করার, মাত্র কয়েকদিনের ব্যাবধানে আমার
জীবনটা যতটা পিছিয়ে গেছে, আমি আবার সেখান থেকে শুরু করতে চাই। এই
একবছরে আরো কয়েকটা বিয়ের প্রস্তাব এসেছিল,
কেউ চায় একটা গাড়ি, কেউ বা ছোট কোন ফ্ল্যাট, কেউ বা নগদ অর্থ। কারণটা কি? কারণ আমি একজন
ডিভোর্সি। কিন্তু জানেন আমার বয়সটা মাত্র ১৯ পেরুলো। আমার একটা ক্লাসমিট ছেলে ছিল একদিন
তার কাছে আমার জীবনে ঘটে যাওয়া কাহিনী গুলো বলছিলাম, সব কিছু
শুনে সে আমাকে বলল তার সাথে বিছানায় যাওয়া জন্য, আমি নাকি নষ্ট হয়ে গেছি, আমার নাকি আর কোন
মূল্য নেই, তাহলে তার সাথে যেতে সমস্যা কোথায়? সেদিন একটা বিয়ে বাড়িতে গিয়েছিলাম, কনে সাজানোর
মত তেমন ভালো কেউ ছিল না, তাই কয়েকজন আমাকে বললে আমি সাজিয়ে দিতে যাই। নিজের কানে শুনিনি তবে পরে কেউ একজন এসে বলে, আমাকে সাজাতে দেখে কনের মা নাকি ফিসফিস
করছিল, এমন শুভদিনে এমন অলক্ষি মেয়েকে দিয়ে সাজানোর কথা কে বলেছে?
অনেক হাঁসি পায়, আমি নাকি এখন অলক্ষি হয়ে গেছি, কিন্তু আমার জন্মের পর আমাকে সবাই অনেক আদর
করতো, সবাই বলতো আমি নাকি আমার বাবার
অনেক লক্ষি মেয়ে হয়ে জন্মেছি। এই আন্টিটাও
ছোটবেলায় আমাকে অনেক আদর করতো, আজ তার কাছেও আমি একজন অলক্ষি মেয়ে হয়ে গেছি। আজ
সবার কাছে আমি একজন নষ্ট, অলক্ষি মেয়ে...
ইতি,
একজন নষ্ট, অলক্ষি মেয়ে!
Comments
Post a Comment